Just In
Don't Miss
মহর্ষি রামানের জীবনদর্শন ও শিক্ষা কীভাবে আমাদের অর্থপূর্ণ জীবন কাটাতে শেখায়?
অদ্বৈত বেদান্ত কী? সহজ ভাষায় বলতে হলে এ হলো হিন্দু শাস্ত্রের উপনিষদের গোড়ার কথা। জ্ঞান অর্জনের দ্বারা আধ্যাত্মিক অনুধাবন।
মানবজীবন রহস্যময়। তাকে নিয়ে যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন মুনি ঋষিরা বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখতে চেয়েছেন। শুরু আর শেষের নিয়তি জানা সত্বেও বারবার জীবনের ব্যাখ্যা খুঁজেছেন। কখনো মানুষকে জ্ঞানের আলোয় পথ চলতে সাহায্য করেছেন, তো কখনো জটিল জীবন দর্শনের সহজ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অনেকের মধ্যে এমন একজন হলেন মহর্ষি রামন। অনেকেই এনার সান্নিধ্যে এসে জীবনের সহজ সমীকরণ খুঁজে পেয়েছেন। কেউ তার নিজের অন্তর্দ্বন্দ্বের মানে খুঁজে পেয়েছে। জীবন দর্শনের উপর মহর্ষির সহজিয়া তত্ত্ব, তাকে বাকিদের কাছে আদর্শ করে তুলেছে। কে এই মহর্ষি রামন, কি তার জীবন দর্শন, কিভাবে দিনের পর দিন ধরে তার প্রভাব মানুষকে শান্তির পথ দেখিয়েছে, এসব নিয়েই আজকের প্রতিবেদন।
তামিলনাড়ুর তিরুচুলিতে জন্মগ্রহণ করেন এই মহর্ষি ১৮৭৯ সালে। সাধারণ তামিল ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম এবং বড়ো হতে ওঠা। ছোটবেলায় তার নাম ছিল ভেঙ্কট রামন আইয়ার। আর পাঁচজন সাধারণ ছেলের মতই বড়ো হয়ে ওঠা। ব্রাহ্মণ পরিবারে বেড়ে ওঠার জন্যে আলাদা করে তার মধ্যে কোন ভক্তিবাদ জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় নি।
একদিন এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকাকালীন হঠাৎ তার শরীর খারাপ লাগে। মৃত্যুর আগের অবস্থার মতই নিজেকে জড়ো লাগতে থাকে। এই সময় তার মধ্যে হঠাৎ চিন্তা আসে যে এই সময় যদি তার মৃত্যু হতো তাহলে কি হতো? এই নশ্বর দেহ ছাইতে পরিণত হতো, কিন্তু আত্মার কি হতো? এটা তো আমার আত্মা যে এই চিন্তা পাঠালো আমার শরীর কে যে এবার বিদায়ের সময় এসেছে। তাহলে মৃত্যুর পর যে দুঃখ বা কষ্ট, তা আত্মার জন্যে নয়, এই নশ্বর দেহের জন্যে? অর্থাৎ এই আমিত্ব যা মানুষকে সমানে নিজের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করে রাখে তা বিনষ্ট হয়না? এরপরে তিনি আর পিছনে না তাকিয়ে নিজেকে নিয়োগ করেন জীবনের সরলীকরণ করতে। অদ্বৈত বেদান্তের অনুরাগী হন। কি এই অদ্বৈত বেদান্ত? সহজ ভাষায় বলতে হলে এ হলো হিন্দু শাস্ত্রের উপনিষদের গোড়ার কথা। জ্ঞান অর্জনের দ্বারা আধ্যাত্মিক অনুধাবন। মহর্ষি মারা যান ১৯৫০ সালে। তার জীবনকালের এই সময়ে জ্ঞানলাভের মধ্যে দিয়ে আত্মাকে চেনা এবং জানা। এই জ্ঞানার্জনের মধ্যে দিয়ে মহর্ষি যে অনুধাবন করেন তার সারমর্ম এই যা আমাদের এক সহজ সরল অর্থপূর্ণ জীবন কাটাতে সাহায্য করেছে।
১. সুখ
মহর্ষির কথায় আমরা সবাই সুখ চাই। সুখী হতে চাই। একইসাথে আমরা সবাই নিজেকে ভালোবাসি অর্থাৎ নিজেকে ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে সুখী বা খুশি হতে চাই। তাই সুখী হতে গেলে তুলনার মধ্যে না গিয়ে আগে নিজেকে খুঁজে পাওয়া উচিত। নিজের আত্মা কিসে সুখ পায় সেটা জানা উচিত।
২. সচেতনতা
আমরা যা করছি তা সচেতন মনে করছি। করা তাই উচিত। আমরা সকালে উঠি বা ঘুমাতে যাই, সবসময় এই সচেতনতা কাজ করে। এই সচেতনতা আমাদেরকে কোনো কিছুর জন্যে ভাবায়, উদগ্রীব করে বা কৌতূহলী করে তোলে। আমরা তখনই কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করা বন্ধ করতে পারি যদি সেই বস্তু বা ঘটনা সম্পর্কে কৌতূহলী না হই। তাই একজনের মধ্যে সচেতনতার বোধ থাকা জরুরি।
৩. মন
মহর্ষি বলেছেন যে মন হলো সর্বোত্তম। কারণ এই মন আমাদেরকে বা "আমি" ভাবকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই মন যখন মস্তিষ্ক বা স্নায়ুর সাথে ক্রিয়া করে তখন আমাদের মধ্যে অহংকার বোধের জন্ম দেয়। কনটু মন যদি শুধুমাত্র হৃদয়ে থাকে তাহলে এই অহং বোধ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আমাদের বুঝতে হবে যে কোনো কিছুর সম্পর্কে অনুধাবন কোনো নতুন জিনিস না, তা শুধুই পুরনো ভুল ধারণার অপসারণ।
৪. জেগে থাকা, স্বপ্ন, ঘুমানো
আমাদের জীবনে এর তিনটে আলাদা প্রভাব থাকলেও মহর্ষি রামন বলেছেন এর আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই। সব আমাদের মনের আলাদা আলাদা সত্ত্বার প্রকাশ। তিনি আরো বলেন যে সময় আসলে মানুষের হিসাব করার একটা ধারণা। সেখানে কোনো অতীত ভবিষ্যত নেই। আছে শুধুমাত্র বর্তমান। আমরা আমাদের সুবিধার্থে একে বছর, মাস, দিনে ভাগ করতে থাকি। তুরীয় অবস্থা হলো জ্ঞান লাভের দ্বারা আসল জেগে ওঠা।
৫. গুরু এবং কৃপা
গুরু আমাদের জীবনের অপরিহার্য নয়। কিন্তু ঠিক পথে চলতে গেলে, কোন জ্ঞান আমাদের জীবনের মন উন্নীত করবে তা জানতে গেলে গুরুর আদর্শ সামনে থাকা জরুরি। তার কৃপা আমাদের আত্মাকে শান্তির পথে চালিত করতে সাহায্য করে।
৬. ভাগ্য এবং ইচ্ছাশক্তি
মহর্ষি এর এক সুন্দর সহজ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন ভাগ্য এবং ইচ্ছাশক্তি আলাদা কিছু নয়। ভাগ্য হলো আজকের ভালো কৃতকর্মের ফল। যা নিজের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে চালিত হয়। নিয়তি হলো আমাদের আগের করা কৃতকর্ম।
৭. আত্মসমর্পণ
আত্মসমর্পণ বা মুক্তির উপায় বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন আত্মসমর্পণ করার দুটো রাস্তা। হয় "আমি" বা আমাত্ববোধের একদম গভীরের উৎসকে খুঁজে নিয়ে সেই উৎসের সাথে নিজেকে নিয়োজিত করতে। নাহলে সর্বশক্তিমান ভগবানই একমাত্র রক্ষক যার পায়ের নিচে এই অসহায় "আমি" কে সমর্পিত করতে। এর ফলে অহংবোধ কাটবে। জীবনের আত্মসমর্পণ সম্পূর্ণ হবে। এরসাথে তিনি বলেছেন যে কেউ গৃহস্থ হোক বা সন্ন্যাসী, আত্মার অনুধাবনের জন্যে বা আত্মসমর্পণের জন্যে তাকে এক দশা থেকে অন্য দশায় যাওয়ার দরকার পড়ে না। কারণ সব ক্ষেত্রেই মন আমাদের সাথে থাকে। তার গভীরের উৎসকে খুঁজে পেলেই এই বিড়ম্বিত অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।