Just In
দেবী কালীর নানা রূপ ও বিভিন্ন কালী মন্দির
কত রূপে পূজিত হন মা কালী? দেখে নিন মায়ের বিভিন্ন রূপ
কলকাতা সহ গোটা পশ্চিমবঙ্গে এমন কোনও জায়গা নেই, যেখানে কালী মায়ের মন্দির নেই। প্রতিদিন সেখানে ভক্ত সমাগম যেমন হয়, তেমনই ভক্তি সহকারে পুজোও হয়। তবে, আমাদের মনে একটা প্রশ্ন সব সময়ই থাকে। তা হল, কালী ঠাকুরের রূপের এতো বিভিন্নতা কেন? এমনকি, মায়ের প্রত্যেক রূপের বর্ণনাই বা কি? সেই রূপের বর্ণনা নিয়েই বোল্ডস্কাইয়ের বিশেষ প্রতিবেদন।
এই কথা সকলেরই জানা যে, মা কালীর সৃষ্টি স্বয়ং মা দুর্গার থেকেই। মূলত, হিন্দুধর্মে মহাশক্তির যে পূজা হয়, তা মাতৃকা নামে পরিচিত। এই মাতৃকা নামক মহাশক্তির সাতটি রূপ। তাঁরা হলেন- ব্রহ্মাণী, বৈষ্ণবী, মাহেশ্বরী, ইন্দ্রাণী, কৌমারী, বারাহি এবং চামুণ্ডা। এই চামুণ্ডাই হলেন, দেবীর ভয়ঙ্কর রূপ।
কালী ঠাকুরের নামের উৎস নিয়েও নানা মতভেদ রয়েছে। যেমন- মা কৃষ্ণবর্ণ বলেই তিনি কালী বা কালিকা নামে পরিচিত। আবার ঊনবিংশ শতাব্দীর সংস্কৃত ভাষার অভিধান শব্দকল্পদ্রুমে বলা আছে, শিবই কাল বা মহাকাল। তাঁর পত্নীই কালী। ইনি মহাদেবের শরীরে প্রবেশ করে তাঁর কণ্ঠের বিষে কৃষ্ণবর্ণা হয়েছেন। পাণিনি অনুযায়ী, কালী' শব্দটি 'কাল' শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ রূপ, যার অর্থ "কৃষ্ণ, ঘোর বর্ণ"। মহাভারত অনুসারে, কালী দুর্গার একটি রূপ। আবার হরিবংশ গ্রন্থে কালী একজন দানবীর নাম।
প্রথমবার কথক গ্রাহ্য সূত্রে দেবী কালীর উল্লেখ পাওয়া যায়। কালীর বর্তমান রূপের উপস্থিতি আমরা পাই মহাভারতের সুপ্তিকা পার্বণে। ষষ্ঠ শতাব্দীর 'দেবী মাহাত্ম্যমে কালীকে 'রক্তবীজ' নামক অসুরকে হত্যা করতে দেখা যায়। দশম শতাব্দীর 'কালিকা পুরাণে' কালীর স্তুতি করা হয়।
১৭৭৭
খ্রীষ্টাব্দে
কাশীনাথ
রচিত
'শ্যামাসপর্যায়বিধি'তে
কালীপূজার
সর্বপ্রথম
উল্লেখ
করা
হয়।
অষ্টাদশ
শতাব্দীতে
নবদ্বীপের
রাজা
কৃষ্ণচন্দ্র
বাংলায়
প্রথম
কালীপূজার
প্রবর্তন
করেন।
ঊনবিংশ
শতাব্দী
থেকে
কালীপূজা
বাংলার
প্রায়
সব
জায়গায়
হতে
শুরু
করে।
আচ্ছা,
বঙ্গদেশে
কেন
এত
হারে
দেবী
কালীর
আরাধনা
করা
হয়?
এমনকি,
দেশভাগের
পরও
বাংলাদেশে
এখনও
বহু
প্রাচীন
এবং
জাগ্রত
কালী
মন্দিরের
অস্তিত্ব
রয়েছে।
যেমন-
শ্রী
শ্রী
চট্টেশ্বরী
কালী
মন্দির,
রমনা
কালিমন্দির,
যশোরেশ্বরী
কালী
মন্দির।
এর
মূল
কারণ
হল,
ব্রহ্মযামল
তন্ত্র
মতে,
কালী
হলেন
এই
বঙ্গের
দেবী।
তবে,
সব
জায়গায়
মায়ের
রূপের
বর্ণনা
ভিন্ন
ধরণের।
দেবী কালীর মূলত আটটি রূপের উপাসনা আমরা করে থাকি। যা তোড়ল তন্ত্র মতে, অষ্টধা বা অষ্টবিধ নামে পরিচিত। এরা হলেন- দক্ষিণাকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, মহাকালী, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালী, শ্মশানকালী এবং শ্রীকালী। প্রধানত শাক্ত ধর্মাবলম্বীরা কালীর পূজা করেন। দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত তন্ত্রমতে পূজিত প্রধান দশ জন দেবীর মধ্যে প্রথম দেবী হলেন কালী। পুরাণ ও তন্ত্র গ্রন্থগুলিতে কালীর বিভিন্ন রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে সাধারণভাবে তাঁর মূর্তিতে চারটি হাতে খড়্গ, অসুরের ছিন্নমুণ্ড, বর ও অভয়মুদ্রা; গলায় নরমুণ্ডের মালা, বিরাট জিভ, কালো গায়ের রং, এবং শিবের বুকের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
ব্রহ্মযামল মতে, কালীর বিভিন্ন রূপভেদ রয়েছে। যেমন - দক্ষিণাকালী, শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, গুহ্যকালী, মহাকালী, চামুণ্ডা ইত্যাদি। আবার বিভিন্ন মন্দিরে ব্রহ্মময়ী, ভবতারিণী, আনন্দময়ী, করুণাময়ী নামে পূজা করা হয়। আশ্বিন মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা কালীপূজা করা হয়।
দক্ষিণাকালী
বঙ্গদেশে সবথেকে বেশী আরাধনা করা হয় দক্ষিণাকালীর। ইনি জায়গা ভেদে শ্যামাকালী নামেও পরিচিত। সারা শরীর নীল বর্ণের, তাঁর মূর্তি ক্রুদ্ধ, ত্রিনয়নী, মুক্তকেশ, চারটি হাত এবং গলায় মুণ্ডমালা। বাম দিকের দুই হাতে নরমুণ্ড এবং খড়গ। ডানহাতে থাকে আশীর্বাদ এবং অভয় মুদ্রা এবং মহাদেবের ওপর দণ্ডায়মানা। তার গলায় পিশাচদের কাটা মাথা দিয়ে বানানো হার শোভা পায়। দুটি শব তার কানের গয়না; কোমরে নরহস্তের কটিবাস।
সিদ্ধকালী
সিদ্ধকালী ভুবনেশ্বরী নামেও পরিচিত। এই দেবীকে গৃহস্থের বাড়িতে পুজো করা হয় না। মূলত, কালী মায়ের সাধকেরা এই পুজো করে থাকেন। সিদ্ধকালীর দুটি হাত, তিনি শরীর গয়নায় আবৃত, তাঁর ডান পা শিবের বুকে এবং বাম পা মহাদেবের দুপায়ের মাঝখানে। এই দেবী রক্ত নয়, বরং অমৃত পানে সন্তুষ্ট থাকেন।
গুহ্যকালী
গুহ্যকালী বা আকালীর রূপ ভয়ংকর। তাঁরও গায়ের রং গাঢ় মেঘের মতো, দুইটি হাত, গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা। কোমরে কালো-বস্ত্র। মাথায় জটা এবং অর্ধচন্দ্র, কানে শবদেহের অলংকার এবং নাগাসনে উপবিষ্টা। এই দেবীর বামপাশে মহাদেবকে বৎসরূপে দেখা যায়।
মহাকালী
শ্রীশ্রীচণ্ডী-তে মহাকালীকে আদ্যাশক্তি, রূপে কল্পনা করা হয়েছে। তার দশ হাতে রয়েছে। তাতে যথাক্রমে খড়গ, চক্র, গদা, ধনুক, বাণ, পরিঘ, শূল, ভূসুণ্ডি, নরমুণ্ড এবং শঙ্খ থাকে।
ভদ্রকালী
ভদ্রকালী নামটি অবশ্য শাস্ত্রে দুর্গা ও সরস্বতী দেবীর অপর নাম। ভদ্রকালীর গায়ের রং নীল, মাথায় জটা, হাতে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা।
চামুণ্ডাকালী চামুণ্ডাকালী বা চামুণ্ডা ভক্ত ও সাধকদের কাছে কালীর একটি প্রসিদ্ধ রূপ। পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী, চামুণ্ডা চণ্ড ও মুণ্ড নামের দুই অসুর বধ করেছিলেন। তার গায়ের রং নীল, পরিধানে বাঘছাল। দুর্গাপূজায় মহাষ্টমী ও মহানবমীর সন্ধিক্ষণে আয়োজিতসন্ধিপূজার সময় দেবী চামুণ্ডার পূজা হয়।
শ্মশানকালী
কালীর এই রূপটির পূজা সাধারণত শ্মশানঘাটে হয়ে থাকে। শ্মশানকালী দেবীর গায়ের রং কালো। তার চোখদুটি রক্তের মতো লাল। বাম হাতে মদ ও মাংসে ভরা পাত্র, ডান হাতে নরমুণ্ড। শ্মশানকালীর আরেকটি রূপে তার বাম পা'টি শিবের বুকে স্থাপিত এবং ডান হাতে ধরা খড়গ। এই রূপটিও ভয়ংকর রূপ।
সেকালের ডাকাতেরা ডাকাতি করতে যাবার আগে শ্মশানঘাটে নরবলি দিয়ে শ্মশানকালীর পূজা করতেন। পশ্চিমবঙ্গের অনেক প্রাচীন শ্মশানঘাটে এখনও শ্মশানকালীর পূজা হয়।
শ্রীকালী
মনে করা হয়, শ্রীকালী দারুক নামক অসুর নাশ করেন। ইনি মহাদেবের শরীরে প্রবেশ করে তাঁর কণ্ঠের বিষে কৃষ্ণবর্ণা হয়েছেন। শিবের মতো ইনিও ত্রিশূলধারিনী ও সর্পযুক্তা।
তথ্যসূত্রঃ
উইকিপিডিয়া, দৈনিক পূর্বকোণ, সনাতন ধর্মতত্ত্ব