Just In
দুর্গা পূজা : কলকাতায় কীভাবে পালিত হয় এই উৎসব
দুর্গা পূজার উৎসব নিয়ে বলতে গেলে সবার প্রথমেই যে জায়গার নাম মুখে আসে তা হল পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা। দুর্গাপুজো হল বাঙালি হিন্দুদের বৃহত্তম উৎসব। আর, কলকাতা বাঙালি হিন্দুপ্রধান শহর হওয়ায় দুর্গাপূজাই কলকাতার বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। এখানেই সবথেকে জাঁকজমক করে হয় এই পুজো। দুর্গা পূজার সময় তিলোত্তমার অনন্য রুপ,লাবণ্য ফুটে ওঠে। নতুনভাবে সেজে ওঠে কলকাতা, যেন আমাদের বহুদিনের চেনা শহরটিকেই নতুন মনে হয়। গোটা শহরকে আলোকমালায় ভরিয়ে দেওয়া হয়। কলকাতার দুর্গাপূজাকে পূর্ব গোলার্ধে রিও কার্নিভাল বলা হয়।
পুজোর পাঁচদিন চারিদিকে গান-বাজনা, অনুষ্ঠানে ভরপুর থাকে। অধিকাংশ অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে মহালয়ায় ও পুজোর পাঁচদিন। বিভিন্ন জায়গায় ছোটো খাটো প্রতিযোগিতার ব্যবস্থাও থাকে। সারা শহর জুড়ে মেলা বসে পুজোর কদিন। সারাদিনই মন্ডপে ভিড় থাকে প্রতিমা দর্শনের জন্য। কিন্তু, সবথেকে বেশি ভিড় হয় রাতে। গোটা শহরবাসী বিভিন্ন মণ্ডপে প্রতিমা দর্শন করতে ভিড় জমান। দুর্গাপূজার সময় কলকাতায় মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ফলে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে কলকাতা পুলিশকে বিশেষ টাস্কফোর্স নিয়োগ করতে হয়।
মহালয়ার মাধ্যমে দেবীর আগমন হয়। এদিন অনেকেই পূর্বপুরুষের স্মরণে গঙ্গায় তর্পণ করতে যান। চণ্ডী পাঠের মধ্য দিয়ে দেবীকে মর্ত্যে আহবান জানানো হয়। শারদীয় দুর্গাপূজার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ এই মহালয়া। এরপর, মহাষষ্ঠী বা বোধনের মধ্য দিয়ে মূল দুর্গোৎসবের শুরু হয়। এরপর, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমী এই পাঁচদিন ধরে মা দুর্গার পুজো করা হয়। নবমীর উচ্ছ্বাস-আনন্দের পরই বিদায়ের সুর নিয়ে আসে বিজয়া দশমী। দশমীর দিন প্রথমে দেবীবরণ। তারপর সিঁদুরখেলা, একে অপরকে মিষ্টি খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে সূচনা হয় বিদায়পর্বের। মা দুর্গা মর্ত্যলোক ছেড়ে কৈলাসে স্বামীর গৃহে ফিরে যান।
হাজার হাজার সার্বজনীন পুজোর পাশাপাশি ৩০০,৪০০ বছরের পুরোনো কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজোগুলিও অত্যন্ত জনপ্রিয়।
বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজো
কথিত আছে, মধ্যযুগে রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ ঐতিহাসিকভাবে বঙ্গদেশে সর্বপ্রথম মহাআড়ম্বরে শারদীয়া দুর্গাপূজা উদযাপন শুরু করেছিলেন। এরপর, অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় নতুন রীতি প্রচলন করে মহালয়ার দিন থেকে শুরু করলেন দুর্গাপুজো। তারপর থেকেই দুর্গাপুজোর নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
কলকাতার বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোর মধ্যে জনপ্রিয় বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো, শোভাবাজার রাজবাড়ির পূজা, হালদার বাড়ি পুজো, লাহা বাড়ির পুজো, মুখুজ্জে বাড়ির পুজো এছাড়াও আরও অনেক বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়।
প্রত্যেকটি বনেদি বাড়ির পুজোর নিয়ম এক হয় না। এক্ষেত্রে, প্রত্যেকের পূর্বপুরুষের নিয়মানুযায়ী সবারই আলাদা আলাদা নিয়ম বিদ্যমান।
বারোয়ারি দুর্গা পূজা
বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে কলকাতায় বারোয়ারি দুর্গাপূজার সূচনা ঘটে। ১৯১০ সালে ভবানীপুরের বলরাম বসু ঘাট রোডে ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভার পক্ষ থেকে বারোয়ারি দুর্গাপূজা আয়োজিত হয়। এই পূজাটি আজও হয়ে আসছে। এরপর ১৯১১ সালে শ্যামপুকুর আদি সর্বজনীন, ১৯১৩ সালে শ্যামবাজারের শিকদারবাগান, ১৯১৯ সালে নেবুবাগান অর্থাৎ বর্তমান বাগবাজার সর্বজনীন এবং ১৯২৬ সালে সিমলা ব্যায়াম সমিতির বারোয়ারি দুর্গাপূজা শুরু হয়। ২০০৮ সালের হিসাব অনুসারে, কলকাতায় দুই হাজারেরও বেশি বারোয়ারি পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৮৫ সাল থেকে এশিয়ান পেইন্টস কর্তৃপক্ষ কলকাতার দুর্গাপূজা কমিটিগুলিকে পুরস্কৃত করার প্রথা চালু করেন। এই পুরস্কারটিকে এশিয়ান পেইন্টস শারদ সম্মান বলা হয়। পরে আরও অনেক বাণিজ্যিক সংস্থা "শারদ সম্মান" বা দুর্গাপূজা পুরস্কার চালু করেছে।
বর্তমানে দুর্গাপুজো মানেই নানারকম থিমের বাহার। সবথেকে বড়ো দুর্গা থেকে শুরু করে, হাজার হাত দুর্গা, ডিজিটাল দুর্গা এসব নানান থিমের কারুকার্য থাকে। প্রতিমা ছাড়াও বেশিরভাগ প্যান্ডেলও তৈরি করা হয় বিভিন্ন থিম দ্বারা। এগুলির ওপর ভিত্তি করে অনেক বাণিজ্যিক সংস্থা বিভিন্ন পুরস্কারও প্রদান করে। দেশ-বিদেশের নানান মানুষ এইসময় কলকাতায় জমায়েত হন প্রতিমা, প্যান্ডেল প্রদর্শনের জন্য।