Just In
দা ফরেস্ট ম্যান অব ইন্ডিয়া!
যাদব "মোলাই" পেয়াং। যদিও এই নামে তাঁকে কেউই চেনে না। তিনি সমগ্র দেশে আজ পরিচিত "দা ফরেস্ট ম্যান অব ইন্ডিয়া" নামে।
হাঁটুর উপর লুঙ্গি। ময়লা জামায় গুঁড়ো মাটির ছোপ। বলিরেখাগুলো যেন সময়ের সাক্ষী বহন করা এক একটা অধ্যায়। হাতে তখনও গুটি কয়েক চারাগাছ ঝুলছে। ওরা অপেক্ষা করছে বৃহত পরিবারের অংশ হতে। আর যার হাত ধরে তারা এই সবুজ বানিনার অংশ হবে আজ, তিনি হলেন যাদব "মোলাই" পেয়াং। যদিও এই নামে তাঁকে কেউই চেনে না। তিনি সমগ্র দেশে আজ পরিচিত "দা ফরেস্ট ম্যান অব ইন্ডিয়া" নামে।
সেদিন ব্রহ্মপুত্র নদ যেন দামাল ছেলে। চারিদিক নয়ছয় করে এগিয়ে চলেছে সামনে। ওদিকে বজ্র গর্ভ মেঘের দল তখন জোরহাটের সেই ছোট্ট গ্রামটার উপর তুমুল দাপাদাপি চালাচ্ছে। অঝোরে বৃষ্টি, সেই সঙ্গে বিপদ সীমার উপর বইতে থাকা ব্রহ্মপুত্র। সেদিন ওই গ্রামের সবাই বুঝেছিল আজ কিছু একটা হবে। তবু বিপদ মাঝেও ভগবান সহায় আছেন, এই ভেবে গ্রামের অধিকাংশই দু চোখের পাতা এক করেছিল। ঘুম যখন ভাঙল, তখন সব শেষ। সবুজে ঢাকা অপরূপ সুন্দর অসমীয় গ্রামটি যেন ন্যাড়া মাঠ। বন্যার চোটে একরের পর একর জঙ্গল যেন মৃত্যুপুরীতে রূপন্তরিত হয়েছে। ইতি উতি ছড়িয়ে প্রাণীদের মৃতদেহ। ভন ভন করছে মাছির দল। বাতাস যেন তখনও মৃত্যু শোকে ভারি হয়ে আছে। এত ধ্বংসের মাঝেও গ্রামবাসীরা বেশ খুশি, কারণ মৃত্যু সেবার ছুঁতে পারেনি কোনও মানুষকে। তাই তারা খুশি। প্রাণ যাক না মূক বন্য়দের, সভ্যরা তো তখনও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। সবুজের মৃত্যুতে কোনও দুঃখ নেই! কারণ বাতাসে যে তখনও অক্সিজেন ফুরিয়ে যাইনি। কিন্তু একজল ছিল ওই ভিড়ে, যে সেদিন খুব কষ্ট পয়েছেল।
"আমাদের কী হবে?"
১৬ বছরের ছোট্ট ছেলেটা এত মৃত্যু তো আগে দেখেনি কখনও। তাই সেদিন খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বারে বারে মনে যেন একটাই প্রশ্ন ফনা তুলছিল, "এবার আমাদের কী হবে?" সেদিন সেই নাবালকের সরল প্রশ্নে বাকিদের কি প্রতিক্রিয়া ছিল জানেন? হাসতে হাসতে সবই একটাই কথায় বলেছিল, "আমরা বেঁচে গেছি। গাছ গেলে গাছ হবে আবার। কিন্তু মানুষের প্রাণ গেলে যে আর তা ফেরে না রে পাগল!"
তবু যেন শান্তি পাচ্ছিল না ছেলেটা। কিছু একটা করতেই হবে। হারিয়ে যাওয়া বনানীকে ফিরিয়ে আনতে না পারলে যে শান্তি নেই। কিন্তু কী করা যায়? এই প্রশ্নটাই বারে বারে ফিরে ফিরে আসছিল মনে। তবে ভাবনা থামলো না। একদিন হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিল ছেলেটা। বাঁশ গাছ লাগালে কেমন হয়! যেমন ভাবনা তেমন কাজ। শুরু হল ছোট ছোট বাঁশ গাছের চারা এনে লাগানো। কিন্তু একার পক্ষে কতটা করা সম্ভব হবে! তাই বার বার বন দফতরে জানাতে লাগলো বাচ্চাটা। ততদিন কয়েক বছর কেটে গেছে। বনদফতরের আধিকারিকরা একদিন সেই যুবাকে জানিয়েই দিল যে তাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব হবে না। যদি কিছু করতেই হয়, তাহলে তা যেন সে নিজেই করে। কথাটা শুনে মাথায় জেদ চেপ গেলে। সেই জেদ থেকেই সেদিন জন্ম হল "দা ফরেস্ট ম্যান অব ইন্ডিয়ার"।
সেই শুরু...
বাঁশ গাছ লাগিয়ে শুরু হওয়া মহিম আরও তীব্র আকার নিল। ছোট ছোট চারা গাছ এনে লাগাতে শুরু করলে সবে ১৮-এয় পা দেওয়া যুবকটি। বাড়তে থাকলো সবুজের ভির। কিন্তু এত গাছকে সে জল দেবে কী করে? উপায় বেরল। বাঁশ গাঁছ কেটে প্রতিটি গাছের উপরে একটি নালা মতো বানানো হল। আর তার উপর মাটির কলসিতে জল। সেই জল চুঁয়ে চুঁয়ে গাছের তৃষ্ণা মেটাতে লাগালো। এক সময় হারিয়ে যাওয়া সবুজ যেন তার পুরনো ঠিকানায় ফিরতে লাগলো। এই সময় হঠাৎই একটা সুযোগ এসে গেল যাদবে পেয়াং-এর কাছে। কী সুযোগ?
১৯৮০ সালের ঘটনা:
গোলঘাট ফরেস্ট ডিভিশনের উদ্যোগে জোরহাট জেলায় শুরু হল গাছ রোপন উৎসব। বাদ পরল না পেয়ং-এর গ্রামও। এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে নাকি! তাই সরকারি উদ্যোগে লেবার হিসেবে হাত লাগালো পেয়ং-ও। এতদিন যে কাজটা শুধুমাত্র সে একা করছিল। আজ কয়েকশো মানুষের হাত ধরে হাজার হাজার গাছ তাদের শিকর খুঁজে পাচ্ছিল। ধীরে ধীরে পেয়ং-এর সেই হারিয়ে যাওয়া ছোট বেলার জঙ্গল ফিরে আসছিল। "স্বপ্ন...আমি স্বপ্ন দেখছি নাতো!" প্রথমটায় এমনই মনে হয়েছিল তাঁর। কিন্তু না, এটা স্বপ্ন ছিল না। একটা মানুষের প্রচেষ্টায় "বানজার" ভূমি সবুজে ঢেকে যাচ্ছিল।
আর আজ:
তিন দশক আগে ব্রহ্মপুত্রের আঘাতে মরে যাওয়া জঙ্গল আজ ১৩৬০ একরে ছড়িয়ে পরেছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার থেকে শুরু করে হাজারো প্রজাতীর প্রাণীর বাস এখনই এই জঙ্গল। জানেন এই জঙ্গলকে কী নামে ডাকে স্থানীয়রা? মোলাই জঙ্গল নামে। যাদব মোলাই পেয়ং, সেদিনের সেই ১৬ বছরের সেই বালকটির চুলে আজ পাক ধরেছে। তবু সংকল্পে একটুও ভাটা পরেনি। এই জঙ্গলের মধ্যেই ছোট বাড়ি বানিয়ে সপরিবারে বসবাস করে সে। কয়েকটি গরু আছে খাঠালে। তাদের দুধ বেচেই সংসার চলে পেয়ং-এর। সেই সঙ্গে চলে মলাই জঙ্গলকে আরও, আরও অনেক বড় আকারে তৈরি করার প্রচেষ্টা। সত্যিই যাদব পেয়ংকে দেখে রবি ঠাকুরের সেই বিখ্যাত গানটা মনে পরে যায়, "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে...."
সম্মানও পয়েছেন অনেক!
২০১৩ সালে জহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর যাদব পেয়ং-কে সম্মান জানানোর পাশাপাশি তাঁকে "ফরেস্ট ম্যান অব ইন্ডিয়া" নামে ভূষিত করেছেন। সেই থেকে সারা দুনিয়া তাঁকে এই নামেই চেনে। এর আগেও পয়েছেন অনেক সম্মান। ভারত সরকারের তরফ থেকেও তাঁকে নানা সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে। পয়েছেন পদ্মশ্রী সম্মানও। যদিও সম্মান বা অর্থের তোয়াক্কা করেন না এই সবুজ বিপ্লবী। তার চোখে একটাই স্বপ্ন, সবুজের জয়যাত্রা যেন কখনও থেমে না যায়।