Just In
যন্ত্রণার রুপকথা
ছাত্রজীবনে একটি রচনা আমরা প্রায় সবাই লিখেছি। তা হল, 'বিজ্ঞান- অভিশাপ না আশীর্বাদ'। এরপর একে একে মারসেল জুনোদ-এর 'দ্য ফার্স্ট অ্যাটম বম্ব' এবং সেন্ট জন গ্রিয়ার এরভিনের 'প্রোগ্রেস' নাটক। এই সবগুলির মধ্যেই মুখোমুখি প্রতিযোগিতায় দাঁড়িয়েছিল, মানবতা এবং মানবতাকে বাজি রেখে চলা গবেষণা। একদিকে আরও আরও এগিয়ে যাওয়ার হাতছানিতে মানুষের জীবন নরক করে তোলা। অন্যদিকে, হাজারো অমানবিক পরীক্ষার দ্বারা সাধারণের হাতে স্বর্গ তুলে দেওয়া, দুই ক্ষেত্রেই জড়িয়ে আছে প্রচুর হৃদয়বিদারক পরিক্ষা-নিরিক্ষা। এত কিছুর পরেও কি পরিস্থিতি বদলেছে? বিজ্ঞানের উন্নতিতে তাঁর প্রয়োগ অনেকাংশেই ধ্বংসের সমার্থক হয়ে উঠছে। ঠিক সেরকমই এক গবেষণা চলেছিল মাশা এবং দাশা, দুই বনের উপর।
কে এই মাশা এবং দাশা? নাম শুনেছি বলে তো মনে হয় না। তবে আর না শুনে থাকা নয়। বোল্ডস্কাইয়ের প্রতিবেদনে আজ এমনই এক অজানা ইতিহাস তুলে ধরা হবে।
আসলে গবেষকরা দস্তানা ঢাকা হাতে মানুষও ইঁদুর হয়ে যায়। হারিয়ে যায় উন্নয়নের জোয়ারে বলি হওয়া প্রাণগুলো।
মাশা ক্রিভোশিলোপোভা এবং দাশা ক্রিভোশিলোপোভা হলেন দুই যমজ বোন। ১৯৫০ সালের ৩'রা জানুয়ারি মস্কোতে এঁরা জন্মগ্রহণ করেন। তবে এঁদের পরবর্তী জীবন আর সবার থেকে একদমই আলাদা। কারণ মাশা এবং দাশা দুজনেই শরীরের নীচের দিক থেকে একে অপরের সঙ্গে জোড়া ছিল। এখানেই শেষ নয়। বরং জীবনের আসল যন্ত্রণার সূত্রপাত হয়েছিল এর পরেই।
জন্মের সময়ই তাঁদের মৃত বলে ঘোষণা করা হয়
মাশা এবং দাশা জীবিত অবস্থাতেই জন্মগ্রহন করেছিলেন। যদিও এই পৃথিবীর কাছে তাঁরা জন্মের মুহূর্তেই মৃত বলে পরিচিত হলেন। জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁদের বিচ্ছিন্ন করা হয় পরিবার থেকে। কারণ মাশা এবং দাশা একই রক্তসঞ্চলন তন্ত্রের অধিকারী ছিলেন অথচ দুই জনের ক্ষেত্রেই স্বতন্ত্র ছিল স্নায়ুতন্ত্র। ডাক্তাররা এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। তাই গবেষণার গিনিপিগ আর ইঁদুরের মতোই, মাশা এবং দাশা দুজনেরই ভাগ্য নির্ধারিত হল গবেষকদের হাতে।
দুজনকেই গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হল
এটি পড়তে গিয়ে রাগে দুঃখে আপনার চোখে জল আসতে বাধ্য। কারণ মাশা এবং দাশা এক পরিবার হারিয়ে আর এক পরিবার পাননি। বরং গিনিপিগের মতোই ব্যবহার হয়েছিল তাঁরা। ছোট্ট নরম দুটি শিশু বিজ্ঞানের কঠিন হাতে সব রকম ভাবে অত্যাচারিত হয়েছে। কখনো তাঁদের ঝলসানো হয়েছে, কখনও আবার বরফে পরিণত করা হয়েছে। আবার কখনও ইনজেকশনের মাধ্যমে শক্তিশালী রেডিও অ্যাকটিভ বিষ শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। না, এক কিছুর পরেও গবেষকদের হাত কাপেনি। কারণ তাঁরা বিজ্ঞান নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন যে।
অমানবিক
গবেষণার এক পর্যায়ে একজনের শরীরে বারংবার সূচ ঢোকানো হয়, যাতে তাঁদের অনুভুতিশক্তি এক কিনা, তা বোঝার জন্য। অন্যদিকে আরও একটি পর্যায়ে একজনকে বরফ জলে দীর্ঘক্ষণ ডুবিয়ে রাখা হয়, এটা দেখার জন্য যে দুজনের শরীরের তাপমাত্রা একভাবে ওঠানামা করে কিনা।
অবর্ণনীয়
এই ধরণের অমানবিক গবেষণার ফলে মাশা এবং দাশা দুজনের জীবনই খুব বাজে ভাবে প্রভাবিত হয়। একই শরীরে মাশা এবং দাশা বেড়ে উঠলেও, তাঁরা দুজন দুই ধরণের মানুষে পরিণত হতে থাকেন। মাশা একদিকে হয়ে উঠেছিলেন ক্ষিপ্ত, বদমেজাজি এবং নির্দয়, এককথায় ভয়াবহ মানসিক রোগী। অন্যদিকে দাশা বড় হতে থাকলেন একজন দয়ালু এবং নিরীহ চিত্তের মানুষ হিসাবে।
মানসিক দূরত্ব বাড়তে থাকে
জীবনের একটা সময় দাশা চেয়েছিলেন, তাঁরা দুই বোন স্বতন্ত্র মানুষ হিসাবে বাঁচুক। কিন্তু মাশা তাতে রাজি হননি। যার ফলে ভালোবাসা, পুনরায় মাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ, চাকরি- সবকিছুই মাশা এক কথায় অস্বীকার করেছেন।
দাশার অধরা স্বপ্ন
আর সবার মতো দাশা ভালভাবে বাঁচতে চেয়েছিলেন। জীবনের একটি পর্যায়ে দাশার জীবনে ভালবাসার একজন মানুষও আসেন। যদিও এবারও বাঁধ সাধেন মাশা। এক্ষেত্রেও অধরাই থেকে যায় দাশার স্বপ্ন।
দাশা স্বনির্ভর হতে চেয়েছিলেন
চাকরি করে স্বাবলম্বী হতে চেয়েছিলেন দাশা। একটি কোম্পানিতে কাজও পেয়েছিলেন। যদিও এবারও বাধা দেয় তাঁর বোন মাশা। কারণ তাঁর কাছে দুঃসহ জীবনকে ভুলে থাকার পন্থা ছিল শুধুই সিগারেট এবং ম্যাগাজিন পড়া।
অবশেষে সাঙ্গ হল খেলা
মাশা এবং দাশা দুজনেই ৫৩ বছর বেঁচেছিলেন। ২০০৩ সালের ১৭'ই এপ্রিল মাশা হঠাৎই হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তবে এবার আর বোনকে একা ছাড়েননি দাশা। মাশার মৃত্যুর ১৭ ঘণ্টা পর মারা যান দাশাও। ডাক্তারদের মতে, মাশার দেহতে পচন ধরার সঙ্গে সঙ্গে সেই বিষাক্ত জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে দাশার শরীরেও। ফলে দুজনেই একসঙ্গে যাত্রা করেন চিরঘুমের দেশে।
দুই বোনের পরস্পরের প্রতি এই ভালোবাসা যেমন এক অনন্য দলিল, তেমনি মাশার জীবনে বেঁচে থাকার স্বপ্ন কীভাবে শেষ হয়ে গেছে বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে, তাও এক মর্মান্তিক বাস্তব।