Just In
দুর্গা পূজা : কলকাতার ঐতিহ্যবাহী কুমোর কলোনী 'কুমারটুলি' সম্পর্কে কিছু তথ্য
আর মাত্র কয়েকটা দিনের অপেক্ষা। তারপরই দীর্ঘায়িত অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে বাঙালীর জীবনে বাজবে সেই চিরাচরিত আনন্দ ধ্বনি, সেই আগমনীর সুর। আকাশে বাতাসে শিউলির গন্ধ আর কাশ ফুলের ছড়াছড়ি। শরতের হিমেল হাওয়ায় জেগে উঠবে ঘুমন্ত পরীরা। কারণ, ঘরের মেয়ে ফিরছে ঘরে। উমা, গৌরি, মৃন্ময়ী যা বলেই ডাকি না কেন তাকে তার আগমনেই শুরু হয় উৎসব। প্রত্যেক বাঙালীর জীবনে প্রেম, ভালোবাসা, নতুন সম্পর্ক এই সব কিছুরই শুভারম্ভ হয় দুর্গা পুজোর মাধ্যমে। এই উৎসবে রাগ, অভিমান সব ভুলে সবাই সবাইকে আপন করে নেয়।
এতক্ষণে আপনারা নিশ্চয়ই বুঝেই গেছেন আমরা কীসের কথা বলছি! হ্যাঁ আমরা বলছি 'দুর্গা পূজা' - সেই আবেগঘন উৎসবের কথা। যার জন্য সারা বছর ধরে অপেক্ষা করা হয়। বাঙালীদের কাছে এই উৎসবের প্রস্তুতি শুরুই হয় প্রায় ছয় মাস আগে থেকে। পুজো প্রস্তুতির আলোচনা, দুর্গা ঠাকুরের মূর্তি তৈরি করা থেকে শুরু করে, পুজোর প্যান্ডেল প্রস্তুতি এই সবকিছুই চলে প্রায় মাসের পর মাস ধরে।
দুর্গা পূজা ও অন্যান্য পুজোর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল প্রতিমা তৈরি। আর এই কাজটি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার ঐতিহ্যবাহী কুমোর কলোনী 'কুমারটুলি'-তে করা হয়। শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের উৎসবের জন্যই নয়,এখানকার তৈরি প্রতিমা বিদেশেও নিয়মিত রফতানি করা হয়। মৃৎশিল্পের জন্য সারা বিশ্বে বিখ্যাত কলকাতার এই 'কুমারটুলি'। বছরের পর বছর, বংশ পরম্পরায় এখানকার মৃৎশিল্পীরা এই মৃৎশিল্পের কাজ করে চলেছে। একটু একটু করে প্রায় ছয় মাস আগে থেকে কুমারটুলিতে দুর্গা প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয়। শুধুমাত্র দুর্গা প্রতিমাই নয়, অন্যান্য দেব-দেবীর মূর্তি তৈরির অঞ্চল হিসেবেও খুব বিখ্যাত এই জায়গা। যখন যে পুজোর মরশুম থাকে তখন সেই দেব-দেবীর মূর্তি তৈরি করা হয়।
কুমারটুলি সম্পর্কে কিছু তথ্য :
ক) কুমারটুলি বিশেষভাবে পরিচিত 'কুমোরটুলি' নামে। কলকাতার অন্যান্য বিস্ময়কর প্রতিভার মধ্যে এটি একটি।
খ) কলকাতার উত্তরভাগে অবস্থিত একটি অঞ্চল। এই অঞ্চলটি 'পটুয়াপাড়া' বা মৃৎশিল্পীদের বসতি অঞ্চল হিসেবে বিখ্যাত। কুমারটুলি অঞ্চলের মৃৎশিল্পীদের দক্ষতার কথা কারুরই অজানা নয়।
গ) কলকাতার এই অঞ্চল থেকে দেব-দেবীর প্রতিমা কেবলমাত্র শহরের সর্বজনীন ও ঘরোয়া পূজার জন্যই সরবরাহ করা হয় না, অনেক ক্ষেত্রেই তা দেশের বাইরের বিভিন্ন দেশেও রপ্তানি করা হয় অর্থাৎ সারা বিশ্বের কাছে বিখ্যাত এই কুমারটুলি। পশ্চিমবঙ্গের একটি বিখ্যাত হস্তশিল্প কেন্দ্রও বটে।
ঘ) ১৯৮৪ সালে প্রতিমা শিল্পী গোরা চাঁদ পাল-এর প্রথম তৈরি করা মাটির দুর্গা প্রতিমা লন্ডনে রপ্তানি করা হয়। যেটা শিল্পপতি লক্ষী মিততালের পূজো বলে পরিচিত।
ঙ) ২০০৬ সালে কুমারটুলি থেকে ১২,৩০০টি দুর্গাপ্রতিমা সরবরাহ করা হয়। প্রতি বছর বিশ্বের ৯৩টি দেশে কলকাতার এই পটুয়াপাড়া থেকে প্রতিমা প্রেরণ করা হয়ে থাকে। বর্তমানে এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
চ) কুমার মানে কুমোর এবং টুলি মানে পল্লি বা পাড়া, তাই কুমারটুলির অনুবাদ হল 'কুমোর পল্লি'।
ছ) ৩০০ বছরেরও বেশি পুরোনো এই কুমারটুলিতে প্রায় ২০০ টি কুমোর পরিবার এখানে বসবাস করে। তাদের জীবিকার একমাত্র উত্স হল প্রতিমা তৈরি করা।
জ) হাজার হাজার কারিগর মা দুর্গা এবং তার চার সন্তান গণেশ, সরস্বতী, লক্ষ্মী এবং কার্তিকের মূর্তিগুলি তৈরি করেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে এবং একজোট হয়ে।
ঝ) অতীতে, কুমারটুলির কুমোররা জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে হাঁড়ি বা নানান পাত্র তৈরির জন্য নদীর তীর থেকে কাদামাটি এনে তা ব্যবহার করত। এখন তারা তাদের সেই সৃষ্টিশীল দক্ষতা বিভিন্ন দেব-দেবী তৈরিতে ব্যবহার করে।
ঞ) কারিগররা রথযাত্রার দিনে পবিত্র 'গড়ালকাঠামো পূজা' শেষে তাদের কাজ শুরু করেন।
ট) প্রতিমা তৈরির তিনটি ধাপ রয়েছে - একদল কারিগর বাঁশ এবং খড় ব্যবহার করে প্রতিমার বাইরের কাঠামো তৈরি করে, অন্য একটি দল কাঠামোর উপরে কাদামাটি লাগায় এবং প্রতিমার মাথা, পা, হাত এগুলি তৈরি করেন প্রবীণ কারিগররা।
ঠ) বর্তমান যুগে 'থিম শিল্পী'-দের রমরমা সত্ত্বেও সনাতন প্রতিমার গুণগ্রাহী আজও কুমারটুলির মৃৎশিল্পীদের দিয়ে প্রতিমা নির্মাণ করান।
ড) পুরুষদের পাশাপাশি কুমারটুলিতে অনেক মহিলা প্রতিমা শিল্পীও রয়েছেন।
ঢ) কুমারটুলি অঞ্চলের নিজস্ব সর্বজনীন দুর্গাপূজার সূচনা হয় ১৯৩৩ সালে। সেযুগের বিশিষ্ট প্রতিমাশিল্পী গোপেশ্বর পাল ছিলেন কুমারটুলি সর্বজনীনের প্রতিমার নির্মাতা।