Just In
Satyajit Ray : 'মহারাজা, তোমারে সেলাম', ১০১তম জন্মবার্ষিকীতে জেনে নিন তাঁর সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য
সত্যজিৎ রায়। এই মানুষটির সম্পর্কে বলার জন্য কোনও শব্দই যথেষ্ট নয়। আপনি যে শব্দই চয়ন করুন না কেন, সমস্তটাই অতীব ক্ষুদ্র বলে মনে হয়। আজ শতবর্ষে পদার্পণ করলেন এই কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা। আসুন আমরা সকলে মিলে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা এবং অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে সত্যজিৎ রায়-কে স্মরণ করি।
সত্যজিৎ রায় কেবলমাত্র সেরা পরিচালকই নন, সেরা চিত্রনাট্যকার, সুরকার, লেখক, প্রযোজক এবং বিখ্যাত গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবেও ভারত তথা বিশ্বের দরবারে পরিচিত। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র আজও বিভিন্ন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের অনুপ্রেরণা যোগায়। রয়-এর হাত ধরেই ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে এক নতুন অধ্যায়ের শুরু হয়েছিল। পাশাপাশি ভারতীয় চলচ্চিত্রকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি। শিশুদের জন্য সিনেমা হোক কিংবা স্বপ্নদ্রষ্টা ও চিন্তা-চেতনা মূলক বড়দের জন্য, বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্র নির্মাতারা আজও এই প্রতিভাবানের সামনে মাথা নত করেন।
চলুন, আজ তাঁর ১০১তম জন্মবর্ষে তাঁর সম্পর্কে কিছু কথা জেনে নেওয়া যাক -
১) ১৯২১ সালের ২ মে কলকাতার এক বাঙালী পরিবারে জন্মগ্রহণ হয় সত্যজিৎ রায়ের। তাঁর পৈতৃক ভিটা ছিল ভারতের কিশোরগঞ্জের (বর্তমান বাংলাদেশের) কটিয়াদী উপজেলার মসুয়া গ্রামে।
২) প্রাথমিক শিক্ষার পর সত্যজিৎ রায় প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন। তবে এই বিষয়টি সম্পূর্ণ তাঁর নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে পড়তে হয়েছিল। কারণ, তিনি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করতে চেয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সির পাট চুকিয়ে মায়ের কথা রাখতে তাঁকে যেতে হয় শান্তিনিকেতনে। নন্দলাল বসুর কাছে শিখলেন ছবি আঁকার প্রাথমিক কলাকৌশল। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় এর কাছ থেকে শিখলেন ক্যালিগ্রাফি। তবুও শান্তিনিকেতনের শিক্ষা সম্পূর্ণ করেননি তিনি, ফিরে আসেন কলকাতার বাড়িতে।
আরও পড়ুন : সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত ১০টি উক্তি, যা আজও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের অনুপ্রাণিত করে
৩) কলকাতা ফেরার পর ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা ' ডিজে কিমারে ' জুনিয়ার ভিজ্যুয়ালাইজার হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। তৎকালীন সময়ে তাঁর বেতন ছিল মাত্র ৮০ টাকা।
৪) ১৯৪৩ সালে কাজ করা শুরু করেন ডিকে গুপ্তের প্রকাশনা সংস্থা ' সিগনেট প্রেস ' এর সঙ্গে। প্রেস থেকে ছাপানো বইগুলোতে তাঁকে প্রচ্ছদ আঁকার অনুরোধ করেন ডিকে গুপ্ত। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের লেখা কালজয়ী বাংলা উপন্যাস 'পথের পাঁচালী' র একটি শিশুতোষ সংস্করণ ' আমআঁটির ভেঁপু ' -এর ওপরেও কাজ করেন তিনি।
৫) ১৯৪৮ সালে তিনি ভিত্তোরিও ডি সিকা দ্বারা পরিচালিত ইতালিয়ান ছবি ' দ্য বাইসাইকেল থিভস্ ' দেখে অনুপ্রাণিত হন এবং তারপরে তিনি 'পথের পাঁচালী' তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। এই সিনেমাটি তৈরি করার পর ভারতীয় সিনেমার প্রেক্ষাপট বদলে দেন তিনি। এই সিনেমাটি ভারতীয় চলচ্চিত্রকে বিশ্বের দরবারে জায়গা করে দেয়।
৬) সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি 'পথের পাঁচালী', তিন বছর ধরে শুটিং হয়েছিল। এই ছবিটি করার জন্য তাঁকে ব্যক্তিগত অর্থ প্রচুর ব্যয় করতে হয়েছিল। অবশেষে ১৯৫৫ সালে মুক্তি পায় ছবিটি। এটি কেবল ভারতে নয় বিশ্বব্যাপী দুর্দান্ত সমালোচনা ও বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করেছিল। এই ছবিটি মোট ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছিল।
৭) তারপরের দুটি ছবি 'অপরাজিত', 'অপুর সংসার' এই তিনটি ছবিই বিশ্বের দরবারে 'অপুর ট্রিলজি' নামে পরিচিত। অপু ট্রিলজির দ্বিতীয় ছবি 'অপরাজিত'-এর বেশিরভাগ অংশই সত্যজিৎ রায়ের নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তৈরি।
৮) অপু ট্রিলজির তৃতীয় ছবি ' অপুর সংসার ' ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায়। ছবিতে অপুর চরিত্রে অভিনয় করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং অপুর নববধূ হিসেবে অভিনয় করেন শর্মিলা ঠাকুর। শর্মিলা ঠাকুরের বয়স তখন মাত্র ১৪ বছর।
৯) সত্যজিৎ রায় ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জুটি সিনেমাকে একটি অন্য মাত্রা দিয়েছিল। একসঙ্গে মোট ১৪টি সিনেমায় কাজ করেন তাঁরা।
১০) অপুর ট্রিলজির পর অন্য ঘরানার ছবি তৈরি করা শুরু করেন। এই সময়ে তাঁর প্রধান চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম হলো চারুলতা, দেবী এবং সন্দেশ।
১১) পরবর্তীকালে নিজের কল্পনা, বিজ্ঞান, কথাসাহিত্য, গোয়েন্দা, নাটক এবং ঐতিহাসিক নাটকের ধারাগুলিকে সিনেমা রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। ছোটদের জন্যও ছবি তৈরি করেন।
১২) সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার বেশ কিছু ডায়লগ তাঁর পিতা সুকুমার রায়ের থেকে অনুপ্রাণিত। যেমন, " ছাতি ২৬, কোমর ২৬, গলা ২৬, আপনি কি মশায় শুয়োর? " সোনার কেল্লার এই বিখ্যাত ডায়ালগ সুকুমার রায়ের 'হ য ব র ল' থেকে নেওয়া হয়েছিল।
১৩) সত্যজিৎ রায় মোট ৩২টি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। এছাড়া ফরাসি সরকারের তরফ থেকে ১৯৮৭ সালে অন্যতম সাম্মানিক পুরস্কার 'লেজিওঁ দনরে' পান তিনি।
১৪) প্রথম রঙিন বাংলা ছবি হিসেবে সত্যজিৎ রায় তৈরি করেন 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' সিনেমাটি। ১৯৬২ সালে মুক্তি পায় ছবিটি।
১৫) সত্যজিৎ রায় হলেন দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব যাঁকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় 'ডি লিট' সম্মানে ভূষিত করেন। প্রথম চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে 'ডি লিট' পেয়েছিলেন চার্লি চ্যাপলিন।
১৬) সত্যজিৎ রায় তাঁর জীবদ্দশায় প্রচুর পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৮৫ সালে ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার 'দাদাসাহেব ফালকে' গ্রহণ করেন। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে ১৯৯২ সালে অ্যাকাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স তাঁকে আজীবন সম্মাননা স্বরূপ 'অ্যাকাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার '(অস্কার) প্রদান করেন।
১৭) ভারত সরকার তাঁকে প্রদান করেন দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান 'ভারতরত্ন'।
১৮) ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল মৃত্যু হয় সত্যজিৎ রায়ের। মৃত্যুর পরেও সেই বছর তাকে মরণোত্তর আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কার প্রদান করা হয়। সত্যজিৎ রায়ের পক্ষ থেকে এই পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন শর্মিলা ঠাকুর।