Just In
- 14 hrs ago ঠাকুরকে নিত্যভোগ দেওয়ার সময় ঘণ্টা বাজে কেন? জানেন কি এর পিছনের রহস্য
- 15 hrs ago প্রখর রোদ থেকে স্বস্তি পেতে বাড়িতেই বানিয়ে নিন এই শরবতগুলি, ঠান্ডা রাখবে শরীরও
- 18 hrs ago গরমে এই পানীয়গুলি খেলে আপনিও থাকবেন হাইড্রেটেড ও সতেজ
- 20 hrs ago কাঠফাটা রোদ থেকে বাঁচতে কী করবেন? এড়িয়ে চলুন চা-কফি
ঋতু বৈচিত্র্যময় ঋতুপর্ণ, চলচ্চিত্র জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র
''সখী
হাম
মোহন
অভিসারে
জাউঁ...
বোলো
হম
এতক
সুখ
কহাঁ
পাউঁ?''
এই বিখ্যাত গানের রচয়িতা তিনি। জীবনযুদ্ধে চড়াই উতরাইয়ে সুখকর জীবন হয়তো এই মানুষটির ছিল না। বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হয়েও উজ্জ্বল ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলেছিলেন সবার মাঝে। তাঁর সৃষ্টি করা 'সম্পদ সমূহ' এই বাধাগুলি দ্বিখণ্ডিত করে সুখের হাতছানি দিয়েছিল তাঁর জীবনে। তাঁর সৃষ্টিগুলি নিজের মতো আমার, আপনাদেরকে সুখায়িত করেছে। তিনি আর কেউ নন, তিনি আমাদের সবার প্রিয় ঋতুপর্ণ ঘোষ।
বাংলার পরিবর্তিত ঋতু বৈচিত্র্যের মতো বাস্তবিক সিনে জগতের বৈচিত্র্যময় ঋতু হলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। সত্যজিত, মৃণাল, ঋত্বিক এই তিন চিরস্মরণীয় ধ্রুবতারার পর চিরস্মরণীয় নক্ষত্র ঋতুপর্ণ ঘোষ। যিনি শুধু একজন পরিচালকই নয়, পাশাপাশি তিনি একজন অভিনেতা ও লেখক। ৩১ অগাষ্ট তাঁর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তাঁকে স্মরণ।
ঋতুপর্ণ ঘোষের জন্ম ১৯৬৩ সালের ৩১ অগাস্ট কলকাতায়। বাবা-মা উভয়েই চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাবা সুনীল ঘোষ ছিলেন তথ্যচিত্র-নির্মাতা ও চিত্রকর। ভারতের LGBT সম্প্রদায়ের এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ঋতুপর্ণ ঘোষ। জীবনের শেষ বছরগুলিতে তিনি রূপান্তরকামী জীবনযাত্রা নিয়ে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন। নিজের সমকামী সত্ত্বাটিকে তিনি জনসম্মুখে খোলাখুলিভাবে স্বীকার করতেন, যা ভারতের চলচ্চিত্র জগতের খুব কম মানুষই করেছেন।
কর্মজীবন :
তিনি ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র ঋতুপর্ণ ঘোষের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার ক্রিয়েটিভ আর্টিস্ট হিসেবে। ১৯৮০-র দশকে বাংলা বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় বেশ কিছু জনপ্রিয় এক লাইনের শ্লোগান লিখেছিলেন তিনি। সেই সময় কলকাতায় ইংরেজি ও হিন্দি বিজ্ঞাপনগুলি বাংলায় অনুবাদ করে চালানো হত। ঋতুপর্ণ বাংলায় স্বতন্ত্র বিজ্ঞাপনী শ্লোগানের ধারা সৃষ্টি করেন। তাঁর সৃষ্ট বিজ্ঞাপনগুলির মধ্যে শারদ সম্মান ও বোরোলিনের বিজ্ঞাপন দুটি বিশেষ জনপ্রিয় ছিল।
তাঁর দুই দশকের কর্মজীবনে তিনি ১২ জাতীয় পুরস্কারের পাশাপাশি কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছিলেন। শুধু ছবিই নয়, তিনি টেলিভিশনে কয়েকটি কাজ করেছেন এবং পাশাপাশি ১৯৯৭ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত একটি জনপ্রিয় ম্যাগাজিনও সম্পাদনা করেছিলেন।
১৯৯২ সালে মুক্তি পায় তাঁর প্রথম ছবি 'হীরের আংটি'। এটি ছিল ছোটেদের ছবি। ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায় তাঁর দ্বিতীয় ছবি 'উনিশে এপ্রিল'। এই ছবিতে এক মা ও তাঁর মেয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের কাহিনি দেখানো হয়েছে। ছবিটি সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবেও সফলতা পায়। ১৯৯৫ সালে এই ছবি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পায়। এরপর, 'দহন' মুক্তি পায় ১৯৯৭ সালে এবং ১৯৯৯ সালে মুক্তি পায় 'অসুখ'। এই দুটি ছবিও জাতীয় পুরস্কার পায়।
২০০০ সালে মুক্তি পায় 'বাড়িওয়ালি'' ও 'উৎসব'। বাড়িওয়ালি ছবিতে মেন চরিত্রে অভিনয় করেন মুম্বই খ্যাত অভিনেত্রী কিরণ খের। এই ছবি এক নিঃসঙ্গ বিধবার কাহিনী। যিনি নিজের বাড়িটি এক ফিল্ম প্রোডাকশনকে ভাড়া দেন। তাঁর কামনাবাসনাগুলি ছবির সুদর্শন পরিচালককে নিয়ে কল্পনার ডানা মেলে। এই ছবির জন্য কিরণ খের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পান।
২০০২ সালে মুক্তি পায় 'তিতলি'। ২০০৩ সালে মুক্তি পায় 'শুভ মহরত'। এই ছবিতে বিশিষ্ট অভিনেত্রী অভিনয় করেন রাখী গুলজার, শর্মিলা ঠাকুর ও নন্দিতা দাস। এই বছরই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে ঋতুপর্ণ ঘোষ তৈরি করেন 'চোখের বালি '। এই ছবিতে বলিউড খ্যাতনামা অভিনেত্রী ঐর্শ্বযা রাইকে নিয়ে কাজ করেন তিনি।
২০০৪ সালে মুক্তি পায় তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি 'রেনকোট'। এই ছবিতে ঐর্শ্বযা রাই-এর সাথে অভিনয় করেছিলেন বলিউড খ্যাত অজয় দেবগণ। এই ছবির শ্যুটিং শেষ হয়েছিল ১৭ দিনে। ছবিটি শ্রেষ্ঠ হিন্দি ছবি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়।
২০০৫ সালে মুক্তি পায় 'অন্তরমহল'। এটি ব্রিটিশ আমলের এক জমিদার পরিবারের গল্প। জ্যাকি শ্রফ জমিদারের চরিত্রটি করেন, তাঁর দুই স্ত্রী-র চরিত্রে অভিনয় করেন সোহা আলি খান ও রুপা গাঙ্গুলি। ২০০৭ সালে 'দ্য লাস্ট লিয়ার' মুক্তি পায়। এটি একটি প্রাক্তন শেক্সপিয়ারিয়ান থিয়েটার অভিনেতার জীবনের গল্প। ভারতের জনপ্রিয় অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। এছাড়াও, প্রীতি জিন্টা ও অর্জুন রামপালও এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন।
২০০৮ সালে মুক্তি পায় 'খেলা'। এটি মানব সম্পর্কের গল্প। এটি মনীষা কৈরালার প্রথম বাংলা ছবি। এই বছরই মুক্তি পায় 'সব চরিত্র কাল্পনিক '। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও বিপাশা বসু অভিনীত এই ছবিটিও জাতীয় পুরস্কার পায়। ২০০৯ সালে মুক্তি পায় 'আবহমান'। এটি শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়।
তাঁর শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি 'চিত্রাঙ্গদা'। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদার কাঠামো অবলম্বনে নির্মিত। এটি ৬০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বিশেষ জুরি পুরস্কার পায়। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর পরবর্তী ছবি সত্যান্বেষী-র শ্যুটিং শেষ করেছিলেন। এই ছবিটি গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীর কাহিনী অবলম্বনে হয়েছিল।
অভিনয় :
শুধু পরিচালকই ছিলেন না। পাশাপাশি তিনি অভিনেতা হিসেবেও জনপ্রিয় ছিলেন। প্রথম অভিনয় করেন ওড়িয়া ছবি 'কথা দেইথিল্লি মা কু'-তে। হিমাংশু পারিজা পরিচালিত এই ছবিটি মুক্তি পায় ২০০৩ সালে। ২০১১ সালে তিনি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের আরেকটি প্রেমের গল্প এবং সঞ্জয় নাগের মেমরিজ ইন মার্চ ছবিতে অভিনয় করেন। আরেকটি প্রেমের গল্প ছবির বিষয় ছিল সমকামিতা। এছাড়াও, তিনি তাঁর শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি চিত্রাঙ্গদাতেও অভিনয় করেছেন।
কিন্তু, হঠাৎই যেন নিভে গেল এই উজ্জ্বল নক্ষত্র। ২০১৩ সালের ৩০ মে নিজের বাড়িতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ঋতুপর্ণ ঘোষ। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৪৯ বছর। শোকে ভেঙে পড়ে বলিউড, টলিউডসহ গোটা চলচ্চিত্র মহল। তিনি চলে গেছেন ঠিকই, কিন্তু, রেখে গেছেন তাঁর জীবনে তৈরি করা অমূল্য কিছু রত্ন। সেই অমূল্য রত্নের বলে আজও তিনি আমাদের মধ্যে বিরাজ করেন।