Just In
করোনা ভাইরাস : কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি কী? জেনে নিন কোভিড-১৯ প্রতিরোধে এটি কতটা কার্যকর
করোনা ভাইরাস-কে হারাতে পারে এমন প্রতিষেধক বা ওষুধের হদিশ এখনও পর্যন্ত মেলেনি। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য, বিশ্বের অনেক দেশেই এর নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কারের চেষ্টা চলেছে। বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসকরা ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য গবেষক এবং চিকিৎসকরা বহু গবেষণামূলক থেরাপি বার করেছেন। এরই মধ্যে শোনা গেল কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপির কথা।
কিছুদিন আগে আমেরিকার হিউস্টন মেথডিস্ট হসপিটালে কোভিড-১৯ পজিটিভ হওয়া রোগীদের উপর 'কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি'(CPT) নামে একটি নতুন থেরাপি চালু করা হয়। বর্তমানে দিল্লির অনেক হাসপাতালে চিকিৎসকরা প্লাজমা থেরাপির মাধ্যমে কোভিড পজিটিভ রোগীদের চিকিৎসা করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। অবশ্য, দিল্লিতে এক করোনা রোগীর উপর প্লাজমা থেরাপি করে প্রথম চিকিত্সায় সাফল্য মিলেছে৷
করোনা ভাইরাস চিকিৎসার জন্য প্লাজমা থেরাপির ব্যবহার কেবলমাত্র দিল্লিতেই নয়, বিশ্বের আরও অনেক দেশেই ব্যবহৃত হচ্ছে। ভারত ছাড়াও আমেরিকা, স্পেন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি, তুরস্ক ও চীনসহ অনেক দেশেই এটি ব্যবহৃত হচ্ছে।
আরও পড়ুন : করোনা ভাইরাস : কোয়ারান্টিনের পরে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি কীভাবে বজায় রাখবেন, রইল তার নির্দেশিকা
ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) অনুসারে, কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি প্রক্রিয়াটি দীর্ঘকাল ধরে রোগীদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর আগে ২০০৩ সালে SARS-CoV, ২০০৯-২০১০ H1N1 এবং ২০১২ সালে MERS-CoV-এর রোগীদের চিকিৎসার জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে এটি। আর, COVID-19-এর সঙ্গে যেহেতু SARS-CoV-এর অনেকটাই মিল, তাই এক্ষেত্রে এই থেরাপি কার্যকর এবং নিরাপদ প্রমাণিত হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে আরও ক্লিনিকাল ট্রায়ালের প্রয়োজন। যদি প্লাজমা থেরাপির ক্লিনিকাল ট্রায়াল সফল হয় তবে করোনা থেকে সেরে ওঠা রোগীদের রক্তের প্লাজমা কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত অন্যান্য রোগীদের চিকিৎসার কাজে লাগবে।
কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি (CPT) কী?
কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি হল একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যাতে করোনা ভাইরাসের কবল থেকে আরোগ্যলাভ করা মানুষের রক্তের প্লাজমা সদ্য আক্রান্ত বা সংকটজনক কোভিড পজিটিভ রোগীর শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। চিকিৎসকদের বক্তব্য, অ্যান্টিবডিযুক্ত প্লাজমা রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে পারে। মানুষের শরীরের ৫৫% হল প্লাজমা বা রক্তরস। এই রক্তরস অ্যান্ডিবডি তৈরি করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে ও যেকোনও সংক্রমণ আটকাতে পারে।
করোনা সংক্রমণ থেকে সেরে উঠেছে এমন ব্যক্তির রক্ত থেকে প্লাজমা নিয়ে অন্য করোনা ভাইরাস-আক্রান্ত রোগীর দেহে প্রবেশ করানো হয়। আসলে, সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠা হওয়া ব্যক্তির শরীরে সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ার ক্ষমতা তৈরি হয় অর্থাৎ কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তির শরীরে তাঁর রক্তরস ভাইরাস-প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরিতে সক্ষম হয়। কাজেই সেই সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তির রক্তরস যদি আক্রান্তের শরীরে প্রয়োগ করা যায় তাহলে সেই অ্যান্টিবডিকে হাতিয়ার করেই রোগীর দেহকোষ লড়াই চালিয়ে যাবে ভাইরাসের বিরুদ্ধে। এই প্লাজমা বা রক্তরসকেই বলা হচ্ছে কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা।
সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তির রক্ত থেকে প্লাজমা বা রক্তরস আলাদা করা হয়। সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তির শরীর থেকে একবারে 400ml প্লাজমা অপসারণ করা হয়। এই 400ml প্লাজমা দুজন সংক্রামিত ব্যক্তির শরীরে দেওয়া যেতে পারে।
চীন সফল হয়েছে
চীনে করোনা ভাইরাসের ঘটনা সামনে আসার পর প্লাজমা থেরাপির ব্যবহার শুরু করা হয়। চীনের যে জায়গায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হয়েছিল, সেখানেও প্লাজমা থেরাপির ব্যবহার করা হয় এবং ইতিবাচক ফলাফলও মেলে।
সার্স, মার্স, ইবোলা প্রতিরোধেও কাজে দিয়েছিল প্লাজমা থেরাপি
প্লাজমা থেরাপি এর আগে অনেকগুলি গুরুতর রোগের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। এর আগে, এই প্লাজমা থেরাপি সার্স এবং ইবোলা-এর মতো প্রচুর রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। ভাইরাসের সাথে সম্পর্কিত অনেক গুরুতর রোগ এই থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়েছে। ২০০৩ সালে যখন সার্স মহামারী হয়েছিল তখন এই থেরাপির প্রয়োগ করা হয়েছিল। সার্সের পরে ২০০৯ সালে ভয়ঙ্কর H1N1 সংক্রমণ রোধে প্লাজমা থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়েছিল, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সফল হয়েছিল। একইভাবে, ২০১৪ সালে ইবোলা-এর মতো বিপজ্জনক ভাইরাস প্রতিরোধেও প্লাজমা থেরাপি ব্যবহার করা হয়। তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (WHO) ইবোলা প্রতিরোধে প্লাজমা থেরাপি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল। ২০১২ সালে মার্স ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতেও প্লাজমা থেরাপির ব্যবহার করা হয়েছিল। এই থেরাপি সবধরনের সংক্রমণ সারাতে পারবে এমনটা নয়, তবে অনেক সংক্রামক রোগ প্রতিরোধেই এই চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োগ করা হয়েছে।
কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি কীভাবে সম্পন্ন করা হয়
এটি একটি খুব দ্রুত প্রক্রিয়া। রক্ত সংগ্রহ এবং রক্তরস অপসারণ এই দুটি উপায়েই এটি সম্পন্ন করা হয় -
ক) পুরো রক্ত সংগ্রহ করা হয় এবং তারপরে তা থেকে রক্তরস পৃথক করা হয়।
খ) অ্যাফেরিসিস মেশিন ব্যবহার করে রক্ত থেকে সরাসরি রক্তরস নিষ্কাশিত করা হয়, অবশিষ্ট রক্ত রক্তদাতার কাছে ফেরত পাঠানো হয়।
কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপির সুবিধা
ক) এটি দুর্বল বা রোগের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের সংক্রমণ রোধ করতে পারে।
খ) এই প্রক্রিয়াটি রোগীর লক্ষণ এবং মৃত্যুর ঝুঁকি হ্রাস করতে কার্যকর।
গ) এটি রোগের চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধে বেশি কার্যকর।
আরও পড়ুন : হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন কী? এতেই কোভিড-১৯ চিকিৎসার দাবি আমেরিকার
এটি কি কোভিড-১৯ এর সাথে লড়াই করতে কার্যকর?
কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি-কে কোভিড-১৯ এর কার্যকর চিকিৎসা বলে সম্বোধন করা যায় না তবে এটি রোগীদের জন্য সহায়ক হিসেবে বলা যেতে পারে। কিন্তু, এই থেরাপি এক্ষেত্রে কতটা কার্যকর তা এখনও অজানা।